Join our telegram Channel Join Now!

ফ্লোরেন্সের আকাশের রহস্যজনক ইউএফও ও এঞ্জেল হেয়ার: নিছক কল্পনা না অমীমাংসিত রহস্য?

 


২৭ অক্টোবর, ১৯৫৪; ফ্লোরেন্স, ইতালি। হ্যালোউইনের তখনও দিন চারেক বাকি। স্টেডিও আর্টেমিও ফ্রাঞ্চি স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। উৎসবের আমেজমাখা সময়ে প্রীতি ফুটবল ম্যাচে মুখোমুখি দুই ক্লাব ফিওরেন্টিনা আর পিস্তোইয়েস। হাজার দশেক দর্শকের চিৎকার আর হুল্লোড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ণ ম্যাচটি আরো জমজমাট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পুরো স্টেডিয়াম নীরব হয়ে গেল। রেফারি বাঁশি পর্যন্ত বাজাতে ভুলে গেলেন। এক অসম্ভব ঘটনা দেখবার দাবি করে সেদিন মাঠে থাকা সকলেই। 

আর দশটা ম্যাচের মতো সাধারণভাবেই শুরু হয় সেদিনের ম্যাচ। মধ্যবিরতি পর্যন্ত আলাদাভাবে উল্লেখ করার মতো কিছু ঘটেনি। বিরতির পর খেলা শুরু হলে হঠাৎ করেই যেন অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। তুমুল উত্তেজনার ম্যাচে মাঠের দিকে চোখ না রেখে দর্শকদের চোখ চলে যায় আকাশের দিকে। বিস্ময় আর আতঙ্কে শব্দশূন্য হয়ে পড়ে পুরো স্টেডিয়াম এলাকা। 

স্টেডিও আর্টেমিও ফ্রাঞ্চি স্টেডিয়াম; Image Source: Locchi Frienze

বিস্ময়ের এই ঘোর দর্শকদের থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মাঠে থাকা খেলোয়াড়দের মাঝে। উত্তেজনাপূর্ণ খেলা ফেলে তারাও বিস্ফোরিত চোখে দেখতে থাকে আকাশে ভেসে বেড়ানো অজানা আতঙ্কের দিকে। যে বলের পেছনে এতক্ষণ ছুটে বেড়াচ্ছিল সবাই, সেই বল নিজেই গড়িয়ে স্থির হলো মাঠের এক কোণে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ রইল না কারও। এসময় সবার নির্বাক বিস্ময়কে বাড়িয়ে আকাশ থেকে মিহি তুলোর মতো কী যেন পড়তে শুরু করল। 

ঘটনার শুরু থেকে যারা দেখেছেন বলে দাবি করেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আকাশের একদিক থেকে হঠাৎ বেশ দ্রুতবেগে বিশালাকার ডিম্বাকৃতির কোনো কিছু স্টেডিয়ামের দিকে আসতে দেখেন তারা। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি পৌঁছে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গতি একেবারে কমিয়ে প্রায় যেন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই অদ্ভুতদর্শন আকাশযানগুলো। 

মেঘের কারসাজি বা আধুনিক কোনো বিমানের মহড়া যে সেগুলো নয়, এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে জোর গলায় দাবি করেন। তবে শব্দহীন, কৃত্রিম এই আকাশযানগুলো ঠিক কী ছিল সেই ব্যাপারে সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে না। সবাই বলাবলি করতে শুরু করল- তারা অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু বা ইউএফও দেখতে পেয়েছে।  

শিল্পীর তুলিতে আঁকা সেই সময়ের কাল্পনিক দৃশ্য; Image Source: bbc.com

মিনিট পনেরো এমনভাবে আকাশে থমকে থেকে ঠিক যেভাবে দ্রুতগতিতে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল, সেভাবেই আবার দ্রুত আকাশ থেকে মিলিয়ে যায় সেই ইউএফও-র সারি। সেগুলোর আকার ঠিক কেমন ছিল এই ব্যাপারে মতান্তর দেখা যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের মাঝে। কেউ সেগুলোকে ডিম্বাকৃতির কিছুটা গোল ধরনের দাবি করে, আবার কেউ বলে সেগুলো দেখতে ছিল চুরুটের মতো লম্বাকৃতির। 

সবার বিস্ময় আরো বেড়ে যায় যখন এই কিম্ভূতকিমাকার ইউএফওগুলো থেকে বৃষ্টির মতো রুপালি তন্তুর ন্যায় কিছু নেমে আসতে শুরু করে। যদিও সেগুলো কারো গায়ে এসে পড়ায় কোনো ধরনের ক্ষতি হয়েছিল- তেমনটা শোনা যায়নি। তবে এই রুপালী তন্তু বা তুলোর মতো বস্তুগুলো সংরক্ষণ ছিল প্রায় অসম্ভব। হাতে ধরলেই সেখুলো গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। 

ঘোর কিছুটা কাটার পর ম্যাচ রেফারি খেলা সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হন, কারণ এমন পরিস্থিতিতে দর্শক বা খেলোয়াড়দের কারোরই খেলা চালিয়ে যাবার মানসিকতা আর ছিলো না। সবার মাথাতেই তখন উঁকি দিচ্ছিল একই ধরনের প্রশ্ন। আসলেই কি তারা মহাকাশযান আর ভিনগ্রহের প্রাণী দেখতে পেয়েছে? নাকি এগুলো শুধুই চোখের ভুল? 

পত্রিকায় ছাপা হওয়া ইউএফও এবং অ্যাঞ্জেল হেয়ারের ঘটনা; Image Source: bbc.com

সেসময় মহাজাগতিক বুদ্ধিমান প্রাণী, উড়ন্ত বেনামী আকাশযান আর ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে জোর আলোচনা চলত। সেই সাথে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই ইউএফও বা এলিয়েন দেখতে পাবার দাবি জানানো হতো। এমন একসময়ে এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়ে হাজারো দর্শক কী মন্তব্য করবে তা-ই ভেবে পাচ্ছিল না।  

অক্টোবরের এই শেষের সময়ে কেবল ফ্লোরেন্স নয়, বরং পুরো টাস্কানী এলাকা জুড়েই শব্দহীন দানবীয় গতির উড়ন্ত এই ইউএফও দেখতে পাবার ঘটনা ঘটতে থাকে। অবাক করা বিষয় হলো- বেনামী এই আকাশযান দেখতে পাবার ঘটনা অনেক জায়গায় ঘটলেও এতে কারো কোনো বিপদ হয়েছে বা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা হয়েছে- এমনটা কেউই বলেনি। সেই একই সময়ে ফ্লোরেন্সের অদূরবর্তী অঞ্চল প্রাটোতে রাতের আকাশে রহস্যজনক সাদাটে আলো ছড়িয়ে পড়তে দেখার অভিজ্ঞতাও জানান অনেকে। 

ইউএফওগুলো যখন ফ্লোরেন্সে স্টেডিয়ামের উপর ঝুলে ছিল, তখন আকাশ থেকে যে রুপালী তন্তু নেমে এসেছিল- সেগুলোর ব্যাপারে শুরু হলো নানা বিশ্লেষণ। অজানা এই বস্তুর জন্য নাম ঠিক করা হলো 'অ্যাঞ্জেল হেয়ার'। রাস্তাঘাট বা বনবাদাড়ে এই অ্যাঞ্জেল হেয়ার নেমে এসে সবকিছু সাদাটে করে ফেলেছিল বলে স্থানীয়রা দাবী করেন। কিন্তু তারা সাথে এটাও উল্লেখ করেন যে, মাটিতে পড়ার কিছুক্ষণ পরই সেটা আপনা থেকেই ভেঙে বা গুঁড়িয়ে যেত। কেউ সেগুলো ধরতে গেলে বা ছুয়ে দেখলেও গুঁড়ো হয়ে যেত। 

অ্যাঞ্জেল হেয়ার পরীক্ষার দৃশ্য; Image Source: locchi Frienze

অ্যাঞ্জেল হেয়ার সংরক্ষণের কাজ যতই কঠিন হোক না কেন, একে পরীক্ষা না করে দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিল না অনেকেই। সত্য জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাই অ্যাঞ্জেল হেয়ার সংরক্ষণের জন্য বাড়ি থেকে বের হন স্থানীয় রিপোর্টার বাতিনি। লোকালয়ের ভেতর এর অস্তিত্ব দ্রুত মুছে গেলেও শহরের ঠিক বাইরে গাছগাছালিতে ঘেরা বনাঞ্চলে এটা পাবার সম্ভাবনা বেশি বলে সেখানেই সরাসরি চলে যান তিনি। 

হাত দিয়ে ধরলে অ্যাঞ্জেল হেয়ার গুঁড়িয়ে যায় বা মিশে যায় এ কথা আগে থেকেই জানতেন তিনি। এজন্য নিজের সাথে রেখেছিলেন ম্যাচের কাঠি আর কাচের জার। বেশ খানিকটা অ্যাঞ্জেল হেয়ার ম্যাচের কাঠির সাহায্যে পেঁচিয়ে নিয়ে জারের ভেতর পুরে ফেললেন বাতিনি। এরপর একে রাসায়নিক পরীক্ষা করানোর জন্য নিয়ে গেলেন ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে।

 ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক পরীক্ষাগার তখন চরম ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। কারণ হিসেবে বাতিনি দেখলেন তার মতো আরো বেশ কিছু আগ্রহী মানুষ ইতোমধ্যেই অ্যাঞ্জেল হেয়ার এনে এখানে পরীক্ষা করাতে দিয়েছেন। বাতিনি এবার অপেক্ষা করতে লাগলেন এটা কী দিয়ে তৈরি তা দেখার জন্য। 

টিউবে রাখা অ্যাঞ্জেল হেয়ার; image source: blog.geolsoc.org.uk

পরীক্ষা করে দেখা গেল- এতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম আর ক্যালসিয়ামের মতো মৌল, যেগুলো আমাদের চেনা অনেক কিছুতেই বিদ্যমান। সেই সাথে এতে রয়েছে তুলনামূলক বিরল মৌল বোরন আর সিলিকন, যেগুলো আমাদের চেনা সব কিছুটে সাধারণত উপস্থিত থাকে না। মূলত, এই রাসায়নিক পরীক্ষা থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে এগুলো মাকড়সার জাল বা আঁশ নয়। কারণ, অভাবিত এ ঘটনা শোনার পর বা দেখার পর অনেকে দাবী করতে শুরু করেছিলো যে অ্যাঞ্জেল হেয়ার আসলে মাকড়সার জাল বা আঁশ। 

সেই সাথে এই তত্ত্বও তারা জুড়ে দিচ্ছিল যে আকাশে দেখতে পাওয়া অদ্ভুতদর্শন অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তুগুলো আসলে একসাথে উড়তে থাকা বিশেষ ধরনের মাকড়সার প্রজাতি, যারা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মাকড়সার তন্তুতে উপস্থিত থাকে নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। এর কোনোটিই অ্যাঞ্জেল হেয়ারে উপস্থিত না থাকায় এই ধারণা দেয়া ব্যক্তিদের আলোচনা এখানেই শেষ করতে হয়। 

অনেকে আবার এই তত্ত্বের বাইরে হাজারো নতুন তত্ত্ব প্রস্তাবনা করতে শুরু করে। মহাজাগতিক যুদ্ধের শুরু, ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের আগমন থেকে শুরু করে শত্রুভাবাপন্ন কোনো দেশের আধুনিক যুদ্ধযানের মহড়া বা চোখের ভুলসহ নানা তত্ত্ব আলোচনায় উঠে আসতে থাকে। এসব ধারণাও যে খুব বাস্তবতানির্ভর বা সত্যের কাছাকাছি ছিল তেমনটা কিন্তু নয়। কিন্তু এটাও সত্য- যে ঘটনা সেদিন এতগুলো মানুষ দেখেছিল, তার কোনো সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। 

অ্যাঞ্জেল হেয়ারের নমুনার ছবি; Image Source: roberto pinotti

আকাশে ভেসে বেড়ানো ইউএফও এবং সেই সাথে আকাশ থেকে নেমে আসা অ্যাঞ্জেল হেয়ারের এই রহস্যজনক ঘটনার পেছনে সত্যতা কতটুকু আর কতটা কল্পনা সেই ব্যাপারে ধারণা করা কঠিন। সেসময়কার পত্রিকা, সাক্ষাৎকার আর ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা নানা তথ্য মিলিয়ে খুব বেশি প্রমাণ এ ব্যাপারে জোগাড় করা সম্ভব হয় না। তবে, হাজারও দর্শক একসাথে যা-ই দেখে থাকুক না কেন, সেটা একেবারে নিছক কল্পনায় গড়া কিছু যে নয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যেতেই পারে। অ্যাঞ্জেল হেয়ারের অংশটুকু সরাসরি মহাজাগতিক প্রাণী বা ইউএফও-র সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলেও আকাশ থেকে নেমে আসা রহস্যময় এই তন্তুর সত্যতার প্রমাণও পাওয়া যায়। 

হয়তো কোনো একদিন অতীতের জমাটবাধা এ ধরনের রহস্যের জট ছাড়ানো সম্ভব হবে। যতদিন না তা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত নিছক গল্প হিসেবেই নাহয় জানা থাকুক ফ্লোরেন্সের এই ইউএফও-র ঘটনা।

Thanks for reading: ফ্লোরেন্সের আকাশের রহস্যজনক ইউএফও ও এঞ্জেল হেয়ার: নিছক কল্পনা না অমীমাংসিত রহস্য?, Sorry, my English is bad:)

Getting Info...

Post a Comment

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.