ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে কিন্তু এডগার অ্যালান পোর নাম শোনেননি, এরকম ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে না জানলেও এই মহান সাহিত্যিককে আপনি চিনতে পারেন, কারণ আমেরিকার গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বসাহিত্যের অনেক দুর্দান্ত সাহিত্যকর্মের রচয়িতা তিনি। আধুনিক ছোটগল্পের ক্ষেত্রে অনেকে তাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করেন। আমাদের অনেকের ছেলেবেলা কেটেছে শার্লক হোমস পাঠের মধ্য দিয়ে, এবং আমরা জেনেছি এই বিখ্যাত গোয়েন্দাচরিত্র স্যার আর্থার কোনান ডোয়েলের হাতে তৈরি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, শার্লক হোমসের ধারণা স্কটিশ সাহিত্যিক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল পেয়েছিলেন এডগার অ্যালান পোর লেখা থেকে। শুধু এই শার্লক হোমসই নয়, পৃথিবীর অসংখ্য খ্যাতনামা সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে তার লেখাগুলো অনুসরণের মধ্য দিয়ে।
দুর্দান্ত সব ভৌতিক ছোটগল্প, খুনের রহস্য কিংবা কবিতার জন্য খ্যাতি লাভ করা এই আমেরিকার সাহিত্যিক বাস্তবে ছিলেন একজন পোড় খাওয়া ব্যক্তিত্ব। জীবন তাকে এমন কঠোর শিক্ষা দিয়েছিল যে অনেকে বলে থাকেন, তার ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-দুর্দশাগুলোকে তিনি কলমের আঁচড়ে তুলে ধরে সাময়িক শান্তি লাভ করতেন। ছোটবেলায় বাবা তাকে ছেড়ে চলে যান, মা মারা যান যক্ষ্মাক্রান্ত হয়ে। তাকে এক ধনী দম্পতি দত্তক নিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তারাই তার স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এডগার পো এই পরিবারে এসে হয়ে যান এডগার 'অ্যালান' পো। তারা চেয়েছিল তিনি ব্যবসায় মনোনিবেশ করুক, আর তিনি সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। যা-ই হোক, পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে এডগার অ্যালান পো সাহিত্যিক হিসেবেই নিজের পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হন।
তার জীবনের শেষ দিনগুলোর দিকে একটু তাকানো যাক। ১৮৪৯ সালের ৩রা অক্টোবর জোসেফ ওয়াকার নামের একজন আমেরিকান কম্পোজিটর গানার্স হল নামের একটি ভবনের দিকে যাচ্ছিলেন, খুব সম্ভবত সংবাদ সংগ্রহের কাজে। সেদিন ছিল বাল্টিমোরের নির্বাচনের দিন, আর গানার্স হল ছিল ভোটকেন্দ্র। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বেশ জনসমাগম ছিল। কিন্তু জোসেফ ওয়াকার হঠাৎ করেই একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষকে দেখতে পান। তার শরীরের কাপড় ছিল একেবারে নোংরা এবং তিনি মাটিতে পড়ে ছিলেন, কোনো নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। কাছে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো। ওয়াকার পোকে এই এই অবস্থায় দেখে ভড়কে যান। তিনি তার কাছে গিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন তার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন কিনা। পো তাকে জোসেফ ই. স্নোডগ্রাস নামের একজন ডাক্তারের নাম জানান এবং অল্প সময়ের মধ্যে ওয়াকার ডা. স্নোডগ্রাসকে একটি চিঠি পাঠান।
এডগার অ্যালান পোকে বাল্টিমোরে উদভ্রান্ত অবস্থায় পাওয়ার এক সপ্তাহ আগে, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৪৯ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। ফিলাডেলফিয়া গমনের কারণ ছিল মিসেস সেইন্ট লিওন লাউড নামের একজন মহিলা কবির কিছু কবিতা সম্পাদনা করে দেয়া। বলে রাখা ভালো, সেসময়ে পো সাহিত্য সমালোচক এবং সম্পাদক হিসেবেও বেশ নাম কামিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর বাল্টিমোরই ছিল তার শেষ গন্তব্য, আর কখনোই তিনি ফিলাডেলফিয়া পৌঁছাতে পারেননি। জোসেফ ওয়াকারই শেষ ব্যক্তি, যিনি রিচমন্ড ছাড়ার পর পোকে দেখতে পান। ৭ অক্টোবর, ১৮৪৯ সালে পো এক হাসপাতালে মারা যান।
এডগার অ্যালান পো যখন মারা যান, তখন তিনি ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে ছিলেন। ডাক্তারের মতে, মৃত্যুর আগে, তিনি তার স্বাভাবিকতা ফিরে পাননি, ক্রমাগত অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলছিলেন। মৃত্যুর আগের রাতে তিনি অনেকবার 'রেনল্ডস' (Reynolds) নামটি উচ্চারণ করেন। এতে তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভিন্ন সন্দেহ ঘনীভূত হয়। তার মৃত্যুর পর বাল্টিমোরের একটি পত্রিকা কারণ হিসেবে 'ফ্রেনাইটিস' নামের এক রোগের কথা উল্লেখ করে, যেটি সাধারণত অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হয়ে থাকে। তবে পত্রিকার উল্লেখ করা কারণ কিংবা ডাক্তারি ব্যাখ্যা অনেক মানুষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি, যার ফলে তার মৃত্যুকে ঘিরে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্ভব হয়। এবার সেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর দিকে একটু চোখ বুলিয়ে আসা যাক।
বাল্টিমোরে ঠিক যেদিন জোসেফ ওয়াকার সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পোকে দেখতে পান, সেদিন নির্বাচন চলছিল। পোকে পাওয়া গিয়েছিল গানার্স হলের একদম পাশে, যেখানে ভোট দিতে আসছিল মানুষ। সেই সময়ের আমেরিকান রাজনীতিবিদদের মধ্যে খুব খারাপ একটি সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। তারা নির্বাচনের সময় এলাকার সবচেয়ে দুধর্ষ ও কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের ভাড়া করতেন। সেই সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষদের অপহরণ করত এবং হত্যার ভয় দেখিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পরিয়ে কয়েকবার করে ভোট দিতে বাধ্য করত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৃহহীন, ভবঘুরে মানুষদের অপহরণ করে এই খারাপ কাজে বাধ্য করত সন্ত্রাসীরা। এতে তারা পেত মোটা অংকের অর্থ আর রাজনীতিবিদরা বেশি ভোট পেয়ে প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে থাকতেন। এই অপসংস্কৃতিকে বলা হতো কুপিং।
অনেকে ধারণা করেন, সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো কুপিংয়ের শিকার। গানার্স হলের পাশে তার পরনে যে পোশাক পাওয়া যায়, তিনি সাধারণত তা পরতেন না। যেহেতু পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ফলে সন্ত্রাসীরা অপহৃত ব্যক্তিকে ভোট দেয়া শেষে মেরে ফেলতো, তাই তার মৃত্যুর পর এই তত্ত্বটি আরও বেশি জনপ্রিয়তা পায়।
তিনি মস্তিষ্কের টিউমারে মারা গিয়েছিলেন– এরকম আরেকটি তত্ত্ব বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তার মৃত্যুর পর সম্মান জানানোর জন্য তার কবরের উপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তখন তার কবর থেকে লাশটি উত্তোলন করার প্রয়োজন হয়। একজন লাশ উত্তোলনকারী শ্রমিক বলেন তিনি লাশের খুলিতে বেশ বড় ধরনের বিকৃতি লক্ষ্য করেছেন। এর পর থেকে অনেক ডাক্তার সন্দেহ করেন যে সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পোর মাথায় হয়তো কোনো ব্রেন টিউমার ছিল এবং মৃত্যুর আগে তিনি এই টিউমারের যন্ত্রণাতেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।
২০০০ সালে পোর রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে লেখা একটি বইয়ে লেখক জন ইভাঞ্জেলিস্ট ওয়ালশ দাবি করেন, পোকে আসলে হত্যা করা হয়। পো যখন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন, তখন তিনি সারা এলমিরা শেলটন নামের বিত্তশালী পরিবারের এক তরুণীর সাথে সম্পর্কে জড়ান, কিন্তু তরুণীর বাবার হস্তক্ষেপে তাদের সম্পর্কের সেখানেই ইতি ঘটে। এর অনেক বছর পরে মৃত্যুর কিছুদিন আগে পোর মনে আবার পুরনো প্রেম জেগে ওঠে। তিনি এলমিরাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, যদিও এলমিরার সন্তানেরা এতে রাজি ছিল না। লেখক জন ওয়ালশ মনে করেন, পো যখন বাল্টিমোরে হাজির হন তখন এলমিরার ভাইদের হাত থেকে বাঁচতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু তার শেষরক্ষা হয়নি, তাই ভাইয়েরা খবর পেয়ে পোকে ধরে ফেলেন এবং বেদম প্রহারের পর মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে বাধ্য করেন, যাতে তিনি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে এই তত্ত্বে বেশ উত্তেজনা থাকলেও থাকলেও শেষপর্যন্ত তা জনপ্রিয়তা পায়নি।
এসব ছাড়াও আরও কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অবতারণা ঘটেছিল, যেগুলোতে বলা হয় যে পো আত্মহত্যা করেছেন কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা গিয়েছেন কিংবা নিউমোনিয়া ও অন্যান্য রোগে মারা গিয়েছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে কোনো তত্ত্বকেই একেবারে শতভাগ সঠিক হিসেবে মেনে নেয়া হয় না। বরং এগুলো তার মৃত্যুকে আরও রহস্যময় করে তোলে। মৃত্যুর এত বছর পরেও একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের মৃত্যুর আসল কারণ জানা যায়নি, এই বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর।
This Bengali article discusse the unsolved case of Edgar Allan Poe's death.
Reference:
১) The (Still) Mysterious Death of Edgar Allan Poe - Smithsonian Magazine
২) The mystery behind the death of Edgar Allan Poe - Shakespearanrag
৩) Why Edgar Allan Poe’s Death Remains a Mystery - Biography
Thanks for reading: এডগার অ্যালান পোর অমীমাংসিত মৃত্যুরহস্য, Sorry, my English is bad:)