প্রথম প্রকাশ: ১০ ই জুলাই, ২০২০, রাত ১১:০০ টা
ডেস্কে বসে বিনোদনের পাতায় চোখ রাখা আমার কাজ। ‘দৈনিক সূর্যদয়’ পত্রিকায় কাজ করছি দীর্ঘ সাত বছর ধরে। আমার আসল নাম ‘শুভন’ কিন্তু অফিস পাড়ার মানুষজন আমাকে ‘নীরব’ বলে ডাকে। খুব সম্ভবত এর প্রধান কারণ আমি খুব বেশি একটা কথা বলি না। কথাবলার মত মানুষও তেমন খুঁজে পাই না। ‘গুড মর্নিং’ দিয়ে দিন শুরু হয় আর শেষ হয় একটি সংক্ষিপ্ত বিদায় দিয়ে। অবশ্য কথা বলবো-ই বা কেন? চিন্তার সাথে চিন্তার মিল দরকার খুব বেশি অনুভূত হয়। যেটা এখনো খুঁজে পাইনি।
অপর পাশের ডেস্কে একজন ক্রাইম রিপোর্টার বসেন। মাত্র কিছু মাস আগে জয়েন করেছেন। মেয়েটা খুব চঞ্চল। কেউ মারা গেলে অথবা আত্মহত্যা করলে অন-স্পটে কোন গোয়েন্দা সংস্থার কেউ হাজির হবার আগেই তিনি সেখানে হাজির হয়ে যান। বয়েস ত্রিশ ছুঁইছুঁই, এখনো অবিবাহিত। দেখতে কাশ্মীরের মেয়েদের মত সুন্দরী। শাড়িতেই নিয়মিত আসেন অফিসে, বাঙালী বলে কথা।
প্রতিদিন আমাকে একবার দেখে ‘গুড মর্নিং’ বলে একটু হেসে থাকেন, তাতেই অবশ্য দিনটা আমার খুব ভাল যায়। কিন্তু বৈপরীত্য হচ্ছে আমাদের কনসেপ্ট নিয়ে। আমি আমার রিপোর্টে কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সম্পর্ক জুড়ে গেলো বা নষ্ট হলো কেন সেসব নিয়ে লিখে থাকি আর উনি লেখেন, “রাজধানী ঢাকায় আবার খুন, পিছনে আছে এক কিশোর গ্যাং” অথবা “ডিপ্রেশনে পড়ে জয়ের আত্মহত্যা।”
একে তো এসবের মধ্যে কোন রসকষ নেই তার উপর দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করায় উনার নিজের মাথাতেও কোন কেমিক্যাল হাইজ্যাক আজ পর্যন্ত হলো না। হবেও বা কি করে! চারদিকে যত ধর্ষণ হচ্ছে তাতে পুরুষ বিদ্বেষী একটা মনভাব আসতেই পারে।
শেষ কবে আমাদের মধ্যে দুই বাক্যের একটা কথোপকথন হলো সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না। এমনিতেও রাজধানীতে একা থাকি, এক ফ্লাটে। বৃদ্ধ মা আছেন, তাকে অনেকবার ঢাকায় আসতে বলেছি কিন্তু স্বামীর ভিটে ছাড়বেন না। তাই তিনি গ্রামেই থেকে গেলেন। গ্রামে চাকুরী নেই তাই আমি ছুটলাম এই ব্যস্ত শহরের দিকে। বাবা যাবার পর খুব উদাসীন থাকতেন, এখন আবার আমাকে ছাড়া একা একা কি করে সময় পার করছেন সেটা ঠিক জানি না। মাস অন্তর কিছু টাকা পাঠিয়ে আমি আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
একটু পরে মনে হলো আমি চিন্তার জগতে ডুব দিয়েছি। সেখান থেকে বের হতেই ডেস্কে একটা ছোট্ট চিরকুট দেখলাম,
“শুভন সাহেব, একটু আমার রুমে আসুন। জরুরী কথা আছে।”
এখন প্রধান সম্পাদক আমায় কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারছি না। যা বলার বলবেন, বেশি না ভেবে আমি উনার রুমের দিকে এগুলাম...
শুভন: স্যার, আমাকে ডেকেছেন?
প্রধান সম্পাদক: হ্যাঁ, আপনি বসুন।
শুভন: স্যার! কোন গুরুতর কিছু কি?
প্রধান সম্পাদক: না, তেমন গুরুতর কিছু নয়। তুমি শেহাব খানের একটি মুভির ব্যাপারে না কি বাজে মন্তব্য লিখেছো? ওটা কি প্রিন্টে গেছে?
শুভন: না, স্যার। এখনো জমা দেয়া হয়নি তবে সন্ধ্যার মধ্যে হয়ে যাবে।
প্রধান সম্পাদক: দেখুন, শুভন সাহেব… আপনি ঐ রিভিউটি প্রকাশ করছেন না। এতে করে আমাদের পত্রিকার ক্ষতি হতে পারে।
শুভন: ঠিক বুঝলাম না, স্যার!
প্রধান সম্পাদক: মানে ওটা আমাদের পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে না।
শুভন: তারমানে একটি অশ্লীল মুভি সম্পর্কে নেতিবাচক কথা লিখবো না! স্যার, এতে আমাদের যুব সমাজের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে। তারচেয়ে বড় কথা হলো এদের পাত্তা দিয়ে দিয়েই তো আমরা আমাদের মাথায় তুলেছি। এখন এদের মুখোশ খুলে দেবার পালা।
প্রধান সম্পাদক: নো, শুভন। তুমি জাস্ট ওটা লিখছো না, বুঝেছো? তোমার চাকুরী চাই না কি ওই রিভিউ?
শুভন: বুঝেছি, কতটাকা খেয়েছেন ওর কাছে থেকে? হ্যা?
প্রধান সম্পাদক: তুমি তোমার লিমিট জানো তো না কি? তুমি যা বলছো এসবের পরিণতি কি হতে পারে আশা করি সেটাও জানো।
শুভন: হ্যাঁ, আমি জানি। আর তাই আমি আজকেই এই চাকুরী ছাড়তে চাইছি। তাছাড়া অথর্বের মত কি করছি! সমাজেও আমার কোন ভূমিকা নেই। অনেকদিন পর ভাবলাম এদের থামানো উচিত। সেটাও করতে দিচ্ছেন না। সত্যি বলতে আজ নিজেকে নিয়ে খুব হাসি পাচ্ছে। ভাল থাকবেন স্যার।
এরপর চাকুরী ছেড়ে দেই। অবশ্য ওই ক্রাইম রিপোর্টার একবার ফোন করেছিলো। ফোন করে বললো, “আমি প্রীতি বলছি। হুট করেই স্যারের সাথে রেগে গিয়ে চাকুরীটা ছেড়ে দিলেন কেন? যদিওবা এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।” এ-পাশে আমি চুপচাপ প্রীতির মিষ্টি কথার মধ্যে একটি মারাত্মক স্নেহ আছে সেটা শুধু অনুভব করে যাচ্ছি। প্রীতি আবার বললো, “চুপ কেন? কিছু তো একটা বলুন?”
অবশ্য আমার হাতে তেমন কিছু বলার ছিলো না কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বললাম, “দেখুন, আপনি তো সবই জানেন। টাকার কাছে বা ধরুন স্রেফ এমন একটি জবের জন্য নিজের নৈতিকতা বোধকে হারাতে পারছিনা, আমি অত্যন্ত দুঃখিত।” প্রীতি আরো অনেক কিছু বুঝালেন মিডিয়া পলিটিক্স সম্পর্কে, কিন্তু আমার মনটা গলাতে পারলেন না।
কিছুদিন পর…
হাতে জমানো টাকাগুলো মদে ফুরাচ্ছি এখন। বিশেষ কোন কাজ খুঁজতেও আর মন চায় না। একা থাকাকেই খুব করে আপন করে নিয়েছি। কিন্তু আমার জীবনে এমন আচমকা কোন ঘটনা ঘটবে তা কোনদিন ভাবিনি।
হ্যাঁ, একদিন সন্ধ্যায় গুলিস্তানের এক ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলাম। চারদিকে যান্ত্রিক এই পৃথিবীটা কেমন ব্যস্ত তা মনোযোগ দিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিলাম। সাথে হকারদের চেঁচামেচি তো আছেই। হঠাৎ পায়ে কি যেন একটা বাড়ি খেলো। ওটা হাতে তুলতেই দেখলাম, একটা ভাঙ্গাচোরা মোবাইল ফোনের মত ডিভাইস। ছোট্ট একটা স্ক্রিন, তাও ঝাপসা। বাকিটা কেউ পা দিয়ে গুঁড়িয়েছে এজন্য এই ডিভাইসের অবস্থা আরো খারাপ দেখাচ্ছে।
একটা বাটন দেখলাম, খুব সম্ভবত ওটা পাওয়ার বাটন হবে। তাই খানিক সময় ঐ বাটনটি প্রেস করে থাকলাম। কিন্তু কোন গতি করতে পারলাম না। ব্যাটারি মনে হয় মৃত্যুবরণ করেছে। তাই আমি আমার পরিচিত এক হাতুড়ে মেকারের কাছে গেলাম। দেখলাম, বরাবরের মত বহু কাজ নিয়ে তিনি ব্যস্ত।
আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়ার যারা আছেন তারাও এত কাজ পায় কিনা সন্দেহ আছে। যাইহোক, আমি তাকে ডিভাইসটি দেখালাম। তিন ঘন্টা অবধি সে ঐ ডিভাইসের দিকে চেয়ে থাকলো। শেষমেশ বলতে বাধ্য হলো যে, “আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না… তবে শোভন… আমি এর একটি কৃত্রিম ব্যাটারি বানিয়ে দিয়ে আগের ব্যাটারি চেঞ্জ করে দিচ্ছি… তুমি অন্তত সেটটি চালাতে পারবে।” আমি বললাম, “তাই করে দাও…”
বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। রাত তখন একটা প্রায়। তখনো গোসল করা হয়নি। তাই গোসল শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে হাফ তেহেরি এনেছিলাম ওটা খেয়ে নিলাম। এখন অবশ্য কিছুটা ভাল অনুভব করছি। তারপর ভাবলাম ঐ ভাঙ্গা ফোনটি কই? দেখি চালু হয় কি না! হ্যাঁ, ডিভাইসটি চালু হয়েছে। প্রথমেই ইংরেজিতে চমকে দেয়া লেখা ভেসে উঠলো ডিভাইসটির স্ক্রিনের উপর, Welcome Mr. Shuvon Islam!
তারপর ছোট্ট ঐ স্ক্রিনের পর্দায় একটি মেয়ে হাজির হলো। তারপর খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “শোভন, আপনি কেমন আছেন?” আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। ভূতুড়ে-ভূতুড়ে একটি ব্যাপার মাথার পাক খেয়ে গেলো। ভাবলাম আমি আবার মদ খাইনি তো! একটু বিষম নিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমি সুস্থ আছি। আপনি কে? আর আপনার নাম কি?”
ডিভাইসটি এবার জবাব দিলো, “আমি মায়া। আর আপনি যেভাবে আমাকে ভয় পাচ্ছেন তাতে কিন্তু আপনার প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। আপনার স্নায়ুগুলো এখন খুব দূর্বল। অনুগ্রহ করে শান্ত হোন।”
এরপর এই ডিভাইসটি আমাকে যা বুঝালো, তা হচ্ছে…
এই ডিভাইসটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে। এবং এখানে উন্নত মানের বায়োটেকনোলজি সংযুক্ত করা আছে। কারো হাতে মাত্র পাঁচমিনিট থাকলেই এই ডিভাইসটি তার সম্পর্কে সব বলে দিতে পারে। তার অতীতের সব স্মৃতি স্ক্যানিং করে ছোট্ট স্ক্রিনে প্রয়োজনে দেখাতেও পারে। আবার কোন যুক্তিকে বিভিন্ন তথ্যর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারে যার শতকরা ৯৯.০১% ঠিক হয়ে থাকে।
ডিভাইসটি থেকে এই কথাগুলো শুনে একটু হাসলাম, প্রথমে ভেবেছিলাম কেউ হয়তো আমার সাথে মজা নিচ্ছে। তাই মজা করেই জিজ্ঞেস করলাম,
“আচ্ছা, এই রাত একটায় প্রীতি কি আমার সাথে বাইরে কফি খাবার জন্য বের হবে?” ডিভাইসটি উত্তরে বললো, “আমাকে এক মিনিট সময় দিন।” একটুপরেই ডিভাইসটি বললো, “হ্যাঁ, প্রীতি আপনার সাথে কফি খেতে যাবেন। আপনি চাইলে ফোন করতে পারেন।”
কৌতুহল জমা না রেখে আমি প্রীতি কে ফোন দিলাম, “প্রীতি, তুমি কি এখুনি আমার সাথে একটু কফি খেতে বের হবে?” প্রীতি সোৎসাহে বলে উঠলো, “নিশ্চয়, এতদিন পরে তবে শুভন সাহেবের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পেলাম।”
আমি আশ্চর্য হয়ে তাড়াহুড়ো করে বললাম, “প্রীতি, তুমি কিন্তু লাল শাড়িটা পড়তে একদম ভুলবে না। ঐ শাড়িটায় তোমাকে দারুণ মানায়।”
ওপাশ থেকে প্রীতির হাসিটা আমাকে সম্মতি জানালো যেনো…
Thanks for reading: ছোটগল্প – এ. আই ( Short Story – AI) , Sorry, my English is bad:)